রাধিকাকে দেখতাম সকাল সাড়ে ৭টার মেট্রোর
সিটে বসে এক মনে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনের ‘সান্তোরিনি’ পড়তে। কয়েক দশক
আগের কথা, তখন মেট্রো রেলের দৌড় ছিল মাত্র টালিগঞ্জ থেকে এসপ্ল্যানেড
পর্যন্ত। আমারও দৌড় ছিল এসপ্ল্যানেড। একটি বেসরকারি ব্যাংকে জয়েন করেছি
সবে। ঠিক সময়ে হাজিরা দেওয়া চাই। সকাল সাড়ে ৮টার আগে মেট্রোতে খুব একটা
ভিড়ও হতো না। অল্প কয়েকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে অফিস যেতাম। মুখ চেনা হয়ে
গিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। মনে পড়ে, লোরেটোর মর্নিং স্কুলের বাচ্চা মেয়েরা
হইহই করতে করতে যেত। শীতের সকালগুলোতে ওদের মাথায় রঙিন খরগোশ-টুপি পরিয়ে
দিত মায়েরা। ছোট্ট ছোট্ট খরগোশের মতো ওরা কম্পার্টমেন্টের ভেতর ছোটাছুটি
করে বেড়াত। শীতের মেট্রো সরগরম থাকত। অনেক চেনা মুখ অবশ্য কুয়াশায় মিশে
থাকত বিশেষ ক’টা দিন, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির প্রায় মাঝ
পর্যন্ত। সাড়ে ৭টায় স্টেশনের সামনে এক ভাঁড় গরম চা খেয়ে টালিগঞ্জ থেকে আমি
যখন ট্রেনের সামনের দিককার কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়তাম, দেখতাম, অনেক
খরগোশ-টুপি পরা বাচ্চা আর কলকল করে একনাগাড়ে কথা বলে যাওয়া তাদের মায়েরা
ছাড়া সামনে-পেছনে আর কেউ নেই। রাধিকাকে আমি সে রকমই অনেকগুলো বাচ্চার মুখ
পেরিয়ে প্রথম দেখি।
ভাবছিলাম, কী করে রাধিকার সঙ্গে আলাপ করা
যেতে পারে। যে বইটি সে পড়ছে, ওটা একটু দেখার জন্য চেয়ে নেব কি সিনেমার
নায়কদের মতো স্মার্ট মুখে? তাহলে তো রাধিকার সঙ্গে শুরুতেই কথা বলা হয়ে
যাবে। আমি এক্ষুণি তা চাইছি না। আমার ইচ্ছে রাধিকা ওর টলটলে চোখ দুটো তুলে
আমাকে একবার অন্তত দেখুক। চোখে চোখে মিলন হোক। তারপর কথা বলা যাবে। কিন্তু
বললে কি ভাষায় বলব, ইংরেজি না বাংলা? দুরুদুরু বুকে আরেকবার তাকালাম
রাধিকার হাতের বইটার দিকে। হালকা নীলাভ মলাট। মোটা মোটা হরফে সোনালি কালিতে
লেখা বিশ্বখ্যাত সেই লেখকের নাম। ইংরেজি বই। রাধিকার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা
শুরু করাটাই ঠিকঠাক হবে বলে মনে হলো।
ভাবতেই দেখলাম, রাধিকা তাকিয়ে আছে আমার
দিকে। সোজা আমারই দিকে। একদৃষ্টে। কেমন যেন বিহ্বল ভাব। চলতে থাকা মেট্রো
রেলের শব্দ, ঝাঁকুনি, কম্পার্টমেন্টের ভেতর বাচ্চাদের জোর হুটোপাটি,
চিৎকার, সব যেন আগে থাকতেই কোনো শুভ সঙ্কেত পেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও যেন
আমার বহু জন্মের হারানো প্রেমিকার চোখে চোখ রাখতে পেরেছি। একটু আগে বুক
ধুকপুক করলেও এখন বেশ জোর পাচ্ছি বলেই মনে হচ্ছে। এই মওকা, মেয়েটার সঙ্গে
কথা বলার। ওকে এক সপ্তাহ ধরে রোজই দেখছি, একটাই বই পড়ে চলেছে। পড়া শেষ হয়
না। কেন সে আমার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখেনি? আমি কি এতই ফেলনা?
আমি গলার মাফলারটায় মোলায়েম করে হাত
বুলিয়ে স্মার্ট হতে চেষ্টা করলেও, কিছুতেই ওর দিকে এগোতে পারছিলাম না।
কারণ, রাধিকার চোখে জল। শীতের সকালের প্রথম মেট্রোটা যখন কারশেড থেকে
বেরিয়ে খুব ধীরে প্ল্যাটফর্মে এসে ঢোকে, ভোরের শিশির বিন্দুগুলো যখন তার
সোনালি গা বেয়ে গড়িয়ে নামে, এক ফোঁটা অশ্রু এখন রাধিকার ময়েশ্চারাইজার
মাখানো টুসটুসে গাল বেয়ে গড়িয়ে ঠিক সেভাবেই অভিমানে ভর করে নেমে আসার
উপক্রম করছে। আমি থমকে গেলাম। ভেবেছিলাম, ওকে জিজ্ঞেস করব, নাম কী? কোথায়
বাড়ি ওর? রোজ সকাল-সকাল কোথায় যাওয়া হয় তার? বিবাহিত কি না? না হলে কোনো
বয়ফ্রেন্ড আছে কি না? এমন একটি প্রশ্নোত্তর—সেশন শুরু হয়ে গেলে এমনিই
এসপ্ল্যানেড এসে যাবে। রাধিকাও যে পাল্টা আমাকে প্রশ্ন করবে না, সেই
গ্যারান্টিই বা কে দেবে? এমনও হতে পারে, সে হয়ত ক্ষেপে গিয়ে আমার কোনো
প্রশ্নের উত্তর দেবে না। শুরুতেই মিষ্টি করে একটা মুখ-ঝামটা দিয়ে হাতে ধরা
বইটিতে ডুব দেবে। কিন্তু ওর চোখের জল আপন খেয়ালে নেমে আসতে চেয়ে আমাকেই
মাঝপথে আটকে দিল! আজব মেয়ে! আচ্ছা, রাধিকা কি পাগল? ‘সান্তোরিনি’ পড়ে কেউ
কি কখনো কাঁদতে পারে? এমন বই কি কারো মনে ভীষণ দুঃখের জাগরণ ঘটাতে পারে?
এমন কি সেরকম বীভৎস ভাব সৃষ্টি করার ক্ষমতাও নেই এই বইয়ের, যাতে প্রচ-
আতঙ্কে ঘাবড়ে গিয়ে পাঠক নিজের মনে কেঁদে ফেলতে পারে। আমি থমকে গেলাম।
অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি, রাধিকার দু’চোখ
বেয়ে নেমে আসছে অশ্রু। টানাটানা দুটি চোখের কোণ বেখাপ্পারকমের কুঁচকে গেছে।
একটু যেন বয়স্ক দেখাচ্ছে ওকে। আমার মনে হলো, রাধিকা যখন মাথায় গোলাপি
রুমাল বেঁধে ভ্যাবলার মতো মুখ করে বই পড়ে, তখন ওকে যত সুন্দর দেখতে লাগে,
ঠিক ততটাই খারাপ দেখায় ওকে কাঁদার সময়ে। কিন্তু ও কাঁদছে কেন? এমন কান্নার
কী রহস্য? শুধুই অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনের গল্পের কারণে? নাকি এই কান্না
অনেক দিন ধরেই ওর ভেতরে ছিল, আজ স্থান-কাল ভুলে সকালের মেট্রোতে অনুকূল
পরিবেশ পেয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ভেবেছিলাম আন্তরিক স্বরে ওকে জিজ্ঞেস করব, ‘আর
ইউ ফিলিং সরো ম্যাম? মে আই হ্যাভ আ চান্স টু হেল্প ইউ?’
কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায়! মুখ দিয়ে
যথারীতি বেরিয়ে এলো, ‘আর ইউ এনগেজড নাও? ক্যান আই হ্যাভ আ চান্স?’ সঙ্গে
যদিও কিছু আফসোস-মার্কা ধ্বনিও বেরিয়ে এলো। ইশ, রাধিকা কি ভাবল কে জানে!
আমি বড় হয়ে গেছি, বেশ কয়েক মাস হলো চাকরি করছি একটি সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে,
কথাগুলো কেন যে কিছুতেই আমার মনে থাকে না, ঠিক সময়ে মনে পড়ে না, কে বলতে
পারে! আমাদের রবীন্দ্রপল্লীর ‘ইলেভেন বুলেটস’ ক্লাবের সামনের রকে বসে আড্ডা
দেওয়াটা বন্ধ করতে হবে। নয়তো মেয়েদের ফিচেল চোখে দেখাটা কমবে না। কোনো
ভালো মেয়ে আমাকে পাত্তা দেবে না। আমার বিয়েও হবে না। এদিকে বাড়িতে বিয়ের
জন্য খুবই তোড়জোড় চলছে আমি চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই। বলছে, বিয়ে না দিলে
ছেলে দায়িত্ব নিতে শিখবে না, বড় হবে না। চিরকাল রকের ছেলেই থেকে যাবে। চোখে
সানগ্লাস দিয়ে মিঠুনের মতো পা ফাঁক করে দিনের পর দিন হেঁটেই যাবে মেয়েদের
পেছনে। আওয়াজ দেবে। সিটি মারবে।
অগত্যা আমি গোবেচারা মুখে ওর দিকে চেয়ে
একটু স্বগতোক্তির ভাব এনে মিনমিনে কণ্ঠে ক্ষমাও চেয়ে নিলাম। বুঝতে পারলাম,
রাধিকার সামনে আমার ক্ষমা চেয়েটেয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে ফেলাটা কেউ
দেখেনি। যাক, ট্রেনের সকলে আমাকে এখনো হিরোই ভাবছে, অবশ্য খেয়াল করার জন্যে
কে-বা হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। আমার আর রাধিকার মাঝে গ-া দশেক খরগোশ-টুপি উঁচু
হয়ে রয়েছে এখন। ওগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রাধিকার কোমল মুখটা আরও মিষ্টি
দেখাচ্ছে। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, ‘কাঁদছেন কেন?’
রাধিকা প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও, পরক্ষণে
নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত চোখ মুছে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, ‘বইটা পড়তে
পড়তে হঠাৎ মনে হলো, জীবনে কিছুই পাওয়া হলো না! মাই লাইফ ইজ সাপ্রেসড,
কমপ্রোমাইজড, আই কান্ট সারভাইভ এনি মোর!’
সর্বনাশ, আবার বইটার কথা! কি এমন কথা লেখা
থাকতে পারে ‘সান্তোরিনি’ উপন্যাসে? যা পড়ে এক বঙ্গ-ললনা শীতের সকালের
মেট্রোতে বসে নিজের জীবন নিয়ে তীব্র হাহুতাশ শুরু দিতে পারে! কি যেন বলছিল
রাধিকা? ওর মনে খুব কষ্ট, নিজেকে চেপে চেপে রেখেছে, বেশি দিন আর বাঁচতে চায়
না। ও আত্মহত্যা করে বসবে না তো?
রাধিকার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। বয়সে
আমার মতোই হবে। খুব বেশি হলে ওর কুড়ি-বাইশ। ত্বক, চুল, পোশাক-পরিচ্ছদ, গাল
আর ঠোঁটের রং, ইংরেজি উচ্চারণ, সব কিছুই বলে দেয় যে ও বড়লোক ঘরের মেয়ে।
আমার মতো রবীন্দ্রপল্লীর কলোনিতে অভাবের মধ্যে বড় হয়নি। কিন্তু কী যেন
হয়েছে মেয়েটার, সব কিছু থেকেও কী যেন নেই। আমি জানি, একমাত্র ভালোবাসা না
পেলেই মানুষ নিজের অজান্তে এমন দুঃখে বিহ্বল হয়ে থাকে। আমি এবার নিশ্চিন্ত
হলাম, রাধিকার কোনো বয়ফ্রেন্ড বা কেষ্ট-ঠাকুর নেই। বুকেও বল পেলাম। সাহস
করে এগিয়ে এসে একেবারে রাধিকার সিটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওর আর আমার মাঝে
এখন এক হাত মাত্র দূরত্ব। রাধিকা বইটি হাতে ধরে আরেক হাতে মাথার গোলাপি
রুমালটি ঠিক করে নিতে নিতে একবার আপাদমস্তক দেখে নিল আমায়। আমার শরীরটাকে
কেউ যেন এভারেস্টের চূড়োতে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলতে ফেলতেও শেষ পর্যন্ত
মহৎ কোনো ক্ষমাগুণে সিক্ত হয়ে আবার সেই কলকাতাতেই তাচ্ছিল্য ভরে ফিরিয়ে
আনল।
‘আপনার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই? আমারও গার্লফ্রেন্ড নেই।’ এবার সরাসরি বলেই ফেললাম।
‘বয়ফ্রেন্ড?’ সুন্দর করে হাসল রাধিকা।
‘হোয়াই নট? বাট, আই ওয়ান্ট আ হিরো! যে হবে খুব শার্প, জেন্টল,...বাট ভেরি
স্মার্ট, স্মার্ট লাইক এ স্পাই। এই নভেলের হিরোর মতো। যাকে দেখলেই মনে হবে,
ইয়া দ্য রিয়েল হিরো—অ্যারাইভড।’
কি মুশকিল বাবা। আমি হিরো কাকে বলে বুঝতে
শিখেছি, ‘মালঞ্চ’ আর ‘মধুবন’ হলে একের পর এক মিঠুন, অনিল কাপুর, জ্যাকি
শ্রফ, সানি দেওলের ঝাড়পিটের সিনেমা দেখে। এদিকে রাধিকা কিনা স্পাইয়ের মতো
জীবনসঙ্গীর খোঁজ করছে? ‘সান্তোরিনি’র হিরো কি জেমস বন্ডের চাইতেও
আকর্ষণীয়? বইটা পড়া নয় আমার, রাধিকাকে চেপে ধরা যেত নয়তো। জোর গলায় বলতে
পারতাম, সব বানিয়ে বানিয়ে লেখা। হিরো সেই-ই হয়, যে রিয়েল লাইফে হিরো হতে
পারে।
রাধিকার সঙ্গে সেই আমার শেষ কথা। শেষ
দেখাও। এরপর আমি ওকে আর সাড়ে ৭টার মেট্রোতে যেতে দেখিনি। হয়ত আমাকে পাশ
কাটাতে ও ইচ্ছে করেই পরের কোনো মেট্রোতে যাচ্ছে। আমি কায়দা করে সকাল ৮টা
থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সবগুলো মেট্রোতেই এসপ্ল্যানেড গিয়ে দেখেছি, রাধিকা
কোথাও নেই। আমার জ্বালায় অস্থির হয়ে সে কি মেট্রোতে যাতায়াত করা ছেড়ে দিল?
কে জানে। মনটা খচখচে রয়ে গেল আমার।
কারণ, রাধিকাকে আমি আর খুঁজে পাইনি। এর
মধ্যে কুড়িটি বছর পেরিয়েছে। মেট্রো রেলের দৈর্ঘ্য বেড়েছে অনেক কিলোমিটার।
এক সুপাত্রীর সঙ্গে আমার বিয়েও হয়েছে। বাবা-মা দেখেশুনে এক সুশ্রী ঘরোয়া
মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটির বড় গুণ হল সে স্বপ্নের জগতের হিরোর জন্য
হাহুতাশ করে না মোটেও। বরং খুব প্র্যাকটিক্যাল এবং বুদ্ধিমতী। কিন্তু ওর
দাদাটি, অর্থাৎ আমার শ্যালক ছিল বিশ্ব-বখাটে। মেয়েদের আওয়াজ দিতে গিয়ে
একবার পূজার সময়ে সারা রাত ভবানীপুর থানার লক-আপে ছিল। বলতে গেলে ওর দাদাকে
আমি বিয়ের পর বেশ ভয়ই পেতাম। বউ আমাকে শাসাত, খবরদার, দাদার মতো যেন তোমার
হাল না হয়! অথচ ওর দাদার সঙ্গে তুলনা করে বরাবর নিজেকে খাটো এবং আনস্মার্ট
বলেই মনে হতো আমার। আর মনে হতো, আমি আসলে খুবই ভদ্র। নিজেকে চেপে রাখতে
রাখতে, কম্প্রোমাইজ করে করে আজ আমার এই দশা। বউয়ের শাসানি শুনতে হচ্ছে
উঠতে-বসতে। এসব ফালতু কথা ভাবতে ভাবতে আমিও একদিন ভদ্রলোক গোছের কিছু একটা
হয়ে উঠলাম।
চেহারায় ভারিক্কি ভাব এলো। চাকরি আর
পরিবার, দুটি দায়িত্বই দিন দিন বাড়তে থাকায় মেয়েদের নিয়ে সবরকম কল্পনা উবে
যাওয়ার উপক্রম হলো। তারপর যেদিন মেয়ের বাবা হলাম, দুনিয়াসুদ্ধ মেয়েকে আমার
কিছুদিনের জন্য নিজের সন্তান বলেও মনে হয়েছিল। সেই ভাবনা অবশ্য বেশি দিন
টেকেনি। তাই একদিন মেট্রো রেলে আবার দেখে ফেলেছিলাম রাধিকাকে।
সন্ধ্যে ৭টার মেট্রো। চাঁদনী চক থেকে
উঠেছিলাম আমি। কালীঘাটে এসে বসতে পেরেই খেয়াল হলো ঠিক আমার মুখোমুখি রাধিকা
বসে আছে। বয়েস বাড়েনি বোধহয়। না হলে আমি একবারেই ওকে চিনে ফেললাম কী করে?
রাধিকার মাথায় গোলাপি রঙের রুমাল নেই। গরমের দিন বলে হয়ত। ওর চারপাশে
ছোটাছুটি করতে থাকা খরগোশ-টুপি মাথায় বাচ্চাগুলোও নেই। বদলে অনেক
প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ জমে রয়েছে আমার আর রাধিকার মাঝখানে। বাচ্চাগুলো
হয়ত আজও সেই সকালের মেট্রোতে যায়। নয়ত ওরা সবাই বড় হয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়তো
মা হয়েছে। আমি সেসব খরগোশ-টুপি পরা বাচ্চাগুলোর কয়েকজনের মুখ মনে করতে
চেষ্টা করলাম। ওদেরই কেউ কি আজ আমার আর রাধিকার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে? বড় হয়ে
গিয়েছে বলে কি আমি আর তাদের চিনতে পারছি না? রাধিকার মাথা নিচু। তবে বই
নেই ওর হাতে। আগের মতোই চারপাশকে অগ্রাহ্য করে চোখ নামিয়ে স্মার্ট-ফোনে
দ্রুত হাতে খুব সম্ভবত চ্যাট করছে। মেসেজ পাঠাবার পর অপেক্ষা করছে চোখবুজে।
ওপার থেকে ফিরতি-মেসেজটি আসামাত্র সেটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মেসেজে আসা
কথাগুলো ওর মনে ভাবান্তর ঘটাচ্ছে থেকে থেকে। কখনো তার গাল আরক্ত হয়ে উঠছে
লজ্জায়। কখনো নিজের মনে হেসে চলেছে নিঃশব্দে। কখনো বা ভীষণই গম্ভীর হয়ে
উঠছে রাধিকার মুখ।
ভেবেছিলাম কিছু বলব ওকে। কিছু একটা।
কিন্তু এত দ্রুত ওর মুখের ভাব পাল্টাচ্ছে যে, কোন ফাঁকে নিজের সামান্য
কথাগুলো পাড়ব, ভেবে উঠতে না পেরে হাল ছেড়ে দিলাম আমি। ভিড় মেট্রোতে কোনো
অচেনা মেয়েকে কাকুর-বয়সী একজন লোকের কিছু একটা বলে ফেলাটা বোধহয় খুব শোভনও
নয়। আমি নীরব রইলাম বাকি রাস্তাটুকু। তবে রাধিকার দিকে চেয়ে ছিলাম আগের
মতোই। একদৃষ্টে। রাধিকা কিন্তু একটিবারের জন্যও আমার দিকে চোখ তুলে দেখেনি।
দেখলে দেখত, আমার হাতে ধরা রয়েছে একটি বই। অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনের
‘সান্তোরিনি’। বইটি আমি সবসময়ে সঙ্গে রাখি। সময় পেলেই পড়ি। বারবার পড়া
সত্ত্বেও বইটিকে কেন যে নতুন লাগে বলতে পারব না। পড়তে পড়তে আমার বয়স বেড়ে
যায়। একই কথা, একই গল্প, বারবার পড়াতেও শখ মেটে না। কেন মেটে না, এমন
অবান্তর প্রশ্নের উত্তর না থাকার জন্যেই হয়ত বইটি পড়তে পড়তে কখনো-সখনো জলও
এসে যায় চোখে।
N. S : http://www.protidinersangbad.com
N. S : http://www.protidinersangbad.com
No comments:
Post a Comment